Nazmul Islam Ananto

profile-pic
Student at Bangladesh University of Engineering and Technology (BUET) studying Computer Science and Engineering (CSE).
Dark Mode

আকাশ ছোঁয়ার গল্প



শূন্য থেকে শুরু

টার্ম ফাইনাল শেষ হয়েছে অনেকদিন । টার্ম ব্রেক প্রায় শেষের দিকে ৷ ডিপার্টমেন্ট থেকে টার্ম ফাইনাল এর আগে যাওয়া হয়েছিল বান্দরবান। কেওক্রাডং জয় করে এসে এবার সবারই সমুদ্র দেখার একটা ইচ্ছা জাগে৷ সেই অনুসারেই কক্সবাজার-সেন্ট মার্টিন এর একটা খসড়া প্ল্যান রেডি করা হয়৷ আর এরপর থেকেই বিপত্তির শুরু ৷

দিন-তারিখ ঠিক করতে গিয়ে সবার সুবিধা বিবেচনা করে দেখা গেল ১২ তারিখের পর সবাই পারবে ৷ এদিকে ১৪ ফেব্রুয়ারি তাহলে ট্রিপের ভেতরেই পড়ে যায় ৷ একলা মানুষদের এতে কোন সমস্যা থাকে না, বরং ভালো হয় আরো ৷ দোকলা মানুষদের অবশ্য একটু-আধটু সমস্যা হয় ৷ বৃহত্তর স্বার্থে শেষমেশ ১২ তারিখই যাত্রার শুরু দিন ঠিক হলো ৷

স্থান যখন প্রথম ঠিক হয় তখন দিন তারিখ আরো আগে ছিল ৷ এখন যখন ফাল্গুনের মধ্যে দিন-তারিখ পড়ে যায় এবং অনেকের বাসায় পারমিশন আনতে আনতে ফেব্রুয়ারি চলে আসে, বুঝা যায় সমুদ্র দেখতে গিয়ে আমরা গুলিস্তান ঘুরে চলে আসতে পারি ৷ খোঁজ নিয়ে দেখা গেল কোন ভালো হোটেলই খালি নেই, আর জাহাজের টিকেট এর ভয়াবহ সংকট ৷ সবকিছু বিচার বিবেচনা করে আবার জায়গা পরিবর্তন, এবার চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার হলো লক্ষ্য ৷

যখন ট্রেনের টিকেট কাটার সময় এসে পড়ে, তখন আবার আরেক বিপত্তি বাঁধে ৷ মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ হঠাৎ করে না করে বসে, ফলে বাকিদের বাসায় শুরু হয় সমস্যা ৷ ‘একসাথে সবাই মিলে যখন যাব বলেছি তার মানে একসাথেই যাব’ এই নীতি মেনে সবাইকে নেয়ার চেষ্টা চালানো হয় এবং টিকেট কাটা স্থগিত থাকে ৷ একদম শেষ মুহূর্তে অনেক ‘না’ এর ভীড়ে দুইজন ম্যানেজ করে ফেলে এবং ১২ তারিখ বিকাল বেলা ঢাকা থেকে ২১ জন ট্রেনে উঠে পড়ে, যাদের জন্য চট্টগ্রামে অপেক্ষারত থাকে আরো ৩ জন ৷ শুরু হলো এই ২৪ জনের যাত্রা ৷

চলছে গাড়ি চাটগাঁতে

শেষদিকে টিকেট কাটায় একসাথে ২১ টা টিকেট পাওয়া যায়নি ৷ ৭ টা টিকেট আলাদা পড়ে যায়, তবে একই কম্পার্টমেন্টে ৷ যদিও এতগুলো সিট এর দরকার ছিল না । দাঁড়িয়ে, নিচে বসে, কখনো কখনো আবার দুই কম্পার্টমেন্ট এর মাঝখানে দাঁড়িয়ে রোলার কোস্টারের ফিল নিতে নিতে যাওয়া হয়েছে ৷ এতে অবশ্য বেশ কয়েকবার সতর্ক সংকেতও শুনতে হয়েছে ৷ দুই-একবার বলার পরেও যখন বুঝতে পারলো যে এতগুলো দামাল ছেলে-মেয়েদের কোন কিছু বলে দমায় রাখা সম্ভব না, তখন তারাও চুপ হয়ে গেল, আমরাও আমাদের মত হৈ-হুল্লোড়ে মেতে থাকি ।

কয়েকদিন আগেই সায়ীদ আর আসিফের জন্মদিন ছিল ৷ ট্রেনেই কেক কেটে তাদের বাসি জন্মদিন পালন করা হয় ৷

হোটেল ম্যালিনা নাকি ম্যানিলা?

ট্রেনে থাকাকালীন থেকেই গুগল ম্যাপে হোটেলের নাম সার্চ দিয়ে দেখা হচ্ছিল হোটেল আসলে কোথায় । হোটেলের নাম নিয়ে এক চরম বিভ্রাট তৈরি হয় । ম্যালিনা-ম্যানিলা সব সার্চ দিয়ে বুঝা গেল স্টেশন রোডের উলটো দিকেই থাকার কথা হোটেল । সেই উলটো দিকে যাওয়ার পর এতদিনের হোটেল ম্যালিনা হয়ে গেল হোটেল ম্যানিলা । আর তার সামনে রিয়া আর অ্যারোমা ।

চট্টগ্রাম এই দুই বাসিন্দা আমাদের রিসিভ করতে চলে আসে । এর মধ্যে অ্যারোমা নিজের হাতে পিজ্জা বানিয়ে নিয়ে আসে আমাদের জন্য । আমাদের জন্য হোটেলে ৫ রুম বরাদ্দ ছিল, মেয়েদের এক রুম আর ছেলেদের বাকি ৪ রুম । কোনরকমে হাত মুখ ধুয়ে সবাই অ্যারোমার পিজ্জার উপর হামলা চালাই । হলফ করে বলে দিতে পারি, এই পিজ্জা দিয়ে ঢাকায় একটা ব্র্যান্ড খুললে সেটা দারুন সাড়া ফেলে দিবে । একটি স্টার্টআপের আইডিয়া এভাবে আমরা জমা রাখলাম ।
অ্যারোমা পুরোপুরি সুস্থ ছিল না । জ্বর নিয়েই সে আমাদের জন্য পিজ্জা বানায় । আর তাই আমাদের সাথে হোটেলেও ছিল না । তার ভাইয়ার সাথে আবার সে চলে যায় তার বাসায়, রিয়া অবশ্য আমাদের সাথে হোটেলেই থেকে যায় । তখন রাত প্রায় সাড়ে বারোটা, আমরা সবাই নিচে নামলাম চা খাওয়ার জন্য, এর মধ্যে মধ্যে কেউ কেউ রাতের খাবারও খাবে ।

৩-৪ মিনিট হেঁটেই একটা সাধারণ রেস্টুরেন্ট দেখে ঢুকে পড়লাম সেখানে । দুই তলা রেস্তোরাঁ, উপরের তলা অন্ধকার থাকলেও আমরা সবাই সেখানে উঠে যাই । আমাদের জন্য লাইটও জ্বালিয়ে দেয়া হয় । এরপর আমরা চট্টগ্রাম এর “নির্দেশ” সমূহের একটা ধারণা পেলাম । ‘একবারের বেশি দুইবার ঝোল দেয়া হয় না’, ‘উপরের তলায় কোন চা দেয়া হয় না’, ‘উপরে পরোটা দেয়া হয় না’ ইত্যাদি ইত্যাদি । এসব “না” কে কিপটামির সাথে তুলনা করা গেলেও এটা আসলে কিপটামির অনেক উর্ধে ।

তাদের দেয়ালের এসব বিধি নিষেধ এবার তারা বাস্তবে দেয়া শুরু করলো । উপরে চা দিবে না তারা । ২৩ জনের মধ্যে মাত্র ৩-৪ জনকে ভাত-বিরিয়ানি দিবে না তারা । যেকোন জায়গায় ট্যুরিস্ট দের প্রতি একটু আলাদা সদয় ব্যবহার করা হয়, আর এখানে যেন ঠিক উলটো । এক দফা তর্কাতর্কির পরে আমরা সবাই নিচ তলায় গিয়ে বসলাম, সেখানে তারা আমাদের চাহিদামত সবকিছু দিল । যেই বিরিয়ানি দিল, তারচেয়ে নীলক্ষেতের বিরিয়ানিও অনেক অনেক ভালো । খাওয়া দাওয়া শেষ করে এবার সবাই হোটেলে গেলাম । সবাই মোটামুটি ক্লান্ত ছিলাম । তার উপর পরের দিন অনেক ধকলের একটা দিন ছিল, তাই মেয়েরা সবাই রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ে । ছেলেরা সবাই এক রুমে জড়ো হয়ে মাফিয়া খেলা শুরু করি । মাফিয়া খেলা সম্পর্কে বলতে গেলে এই খেলার নিয়ম আগে বলতে হবে, সেটা আপাতত থাক । তবে পরের রাতের মাফিয়া খেলা সম্পর্কে কিছু বলা হবে, সেটা তোলা থাক ।

গ্রামবাসী সবাই জেগে উঠো!

খেলা শেষ করে সবাই যে যার রুমে যেতে যেতে রাত ৩টা বেজে যায় প্রায় । ৩১৮ নাম্বার রুমে আমি, অনন্ত, আবাবিল, অঙ্গন এবং আজগর। কারো চোখেই ঘুম আসতেছে না । আর সজাগ মস্তিষ্ক সবসময়ই কুবুদ্ধির উদয় দেয় । ৩০৪ নাম্বার রুমে থাকা রাজিনকে ফোন দেয়া হলো, ফোন ধরলো আসিফ । কথোপকথনটা এরকম

-(আসিফ) হ্যালো, হ্যা বল -(আমি) তুই কেন? রাজিন কই? -(আসিফ) রাজিন বাথরুমে -(আমি) তাইলে তুই ফোন ধরবি কেন? -(এভাবে কিছুক্ষণ আজাইরা প্যাচাল এর পর রাজিন আসলো) হ্যা বল -(আমি) তোর ফোন আসিফ ধরলো কেন? -(রাজিন) আমি বাথরুমে ছিলাম তো -(আমি) তুই বাথরুমে ফোন নিয়ে যাস নাই কেন? -(রাজিন) বাথরুমে ফোন নিব কেন?! -(আমি) তাইলে তুই বাথরুমে কি করলি? টাইলস গুনছিস? -(রাজিন) আমি বাথরুমের টাইলস গুনব কেন?! -(আমি) মিম দেখিস নাই মোবাইল না নিয়ে গেলে বাথরুমে টাইলস গুনে? আচ্ছা এখন গুনে বল কয়টা আছে
-(রাজিন) ওই আসিফ দেখ তো বাথরুমে টাইলস কয়টা (কিছুক্ষণ পর) ৭ টা টাইলস -(আমি) বাথরুমে মাত্র ৭টা টাইলস?! কি সাইজের বাথরুম তোর?! -(রাজিন) রম্বসাকার -(আমি) রম্বাসাকার বাথরুম?! -(রাজিন) হ্যা, দাড়া আমি আসছি বাথরুমে। আচ্ছা টাইলস আছে ৩২ টা । -(আমি) তুই কি এখন বাথরুমে দাঁড়ায় আমার সাথে কথা বলতেছস? -(রাজিন) হ্যা -(আমি) আরে খাচ্চর নাকি! [ফোন কেটে দেয়া হলো]

ঐদিকে ৩০৬ নাম্বার রুমে আবার কাভী তার গল্প দিয়ে সবাইকে জাগিয়ে রাখে । সাড়ে ৪ টার দিকেও সায়ীদ এদিক ওদিক ঘুর ঘুর করে কাউকে ডাকার চিন্তা ভাবনা করে । শেষমেশ ৫ টার দিকে ঘুমোতে যায় । আর তার আধা ঘন্টা পরেই শুরু হয় প্রতি রুমে তাণ্ডব ।

আমার কখন ঘুম আসে খেয়াল নাই, কিন্তু চোখ বন্ধ করার একটু পরেই মনে হয় চোখ খুলতে হয় এলার্মের আওয়াজে । উঠে অজু করে আবাবিলকে ডেকে বললাম, আমি নামাজ পড়তে গেলাম, তুই ডাক দিতে থাক সবাইকে । এসে দেখি বান্দা তখনো ঘুমে । ধাক্কাধাক্কি করে সবাইকে উঠানো হলো । কারো কম্বল টেনে, ফ্যান ছেড়ে দিয়ে, যেভাবে পারা যায় । মোটামুটি সবাই যখন আস্তে আস্তে উঠে পড়ে, ৩২০ নাম্বার রুমের সবাই এক এক করে আমাদের রুমে আসে আর একেকটা অভিযোগ করে ।

৩২০ নাম্বার রুম

ঐ রুমে ছিল রাতুল, নাফিস, শিয়াম, জামিল এবং মামুন । রাতুল আর জামিল দেশ বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শুরু করে মাঝরাতে । আর এই আলোচনার নীরব শ্রোতা থাকে বাকি ৩ জন । অন্যরা কিছু না করলেও নাফিস রাতুলের উপর ঠিকই ক্ষোভ ঝারে ঘুমের মধ্যে । আর এতে রাতুল ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে পাশের বিছানার থাকা বাকি ৩ জনের কাছে চলে আসে আর চিল্লাতে থাকে “মামা নাফিস জানি কেমন কেমন করে!” পাশে রাতুলকে না পেয়ে নাফিস তখন এই বিছানায় এসে ৪ জনের উপর শুয়ে পড়ে । এভাবে কিছুক্ষণ চলতে থাকলে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে রাতুল-নাফিস আবার তাদের বিছানায় ফেরত যায় । তারপর শুরু হয় নাফিসের এলার্ম । প্রতি আধা ঘন্টা পর পর নাফিসের মোবাইলে অদ্ভুত গানের আওয়াজের এলার্ম বাজতে থাকে, একদিক দিয়ে সবাই যেমন নাফিসকে গালি দিতে থাকে অন্যদিক দিয়ে তাদের গান মুখস্থ হতে থাকে । এই মুখস্থ গান তারা ট্যুরের বাকিদিনগুলো অন্যদের খুব সুন্দরভাবে শোনাতেও থাকে । তবুও দিনশেষে ৩২০ নাম্বার রুমের পুরো রহস্য উন্মোচিত হয় নাই । ধারণা করা হয় ঘুমের মধ্যে অনেক কিছুই হয়েছিল কিন্তু হয়তো তাদের মনে নাই ।

এসব আলোচনা শেষে সকাল সাড়ে ৬ টার পরে আমরা দুই মাইক্রোতে করে মিরসরাই এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি । পথিমধ্যে অ্যারোমা আর সাকিবকে তুলে নেয়া হয় ।

মিশন খৈয়াছড়া

খৈয়াছড়া ট্রেইলটা অনেকগুলো ঝর্ণার সমন্বয়ে তৈরি । আমাদের হাঁটা শুরু হয় প্রায় ৮ টার দিকে। প্রথম ঝর্ণা পর্যন্ত তেমন কোন কঠিন পথ ছিল না । সোজা রাস্তা দিয়েই হেঁটে গেছি আমরা । প্রথম ঝর্ণা তে দাঁড়িয়ে আমাদের ঝর্ণার চূড়া দেখার জন্য একদম মাথা উঁচু করতে হয়েছে । সেই চূড়ায় যেতে হবে আমাদের, পথ খুঁজে পেলাম পাশেই, প্রায় খাড়া পাহাড়ে দড়ি লাগানো । অ্যারোমা অসুস্থ ছিল, আর নাফিসের উচ্চতা ভীতি, তাই অ্যারোমা, কাভী আর নাফিস নিচেই রয়ে যায় । বাকিরা আমরা অভিযান শুরু করি ।

এক হাতে রশি ধরে, অন্য হাতে মাটি ধরে উঠতে লাগলাম আমরা । জামা-কাপড় আর ধুলাবালি তখন মিলেমিশে একাকার । প্রতিটা পদক্ষেপে ছিল সতর্কতা । কষ্ট করে যখন সবাই উপরে উঠলাম তখন অন্যরকমের এক প্রশান্তি কাজ করে নিজের ভেতর । একটা মিষ্টি আত্মতৃপ্তিতে ছেয়ে যায় পুরো মন । নিজেকে নিয়ে গর্ব হয়, আশেপাশের মানুষগুলোকে নিয়ে গর্ব হয় যখন উপর থেকে নিচে তাকিয়ে ঝর্নাটা দেখি ।

পাহাড়ের মাঝে দিয়ে খন্ড খন্ড পাথরের পথ দিয়ে আমাদের রাস্তা চলতে থাকে । সেই রাস্তা ধরেই আমরা হাঁটতে থাকি । রাস্তার মাঝে মাঝেই ঝোপঝাড় পরে, সেই ঝোপঝাড়ে থাকে বেশ কাটাওয়ালা গাছ, এসব গাছ হাতে পায়ে লেগে অনেকের হালকা-পাতলা রক্তও ঝরে । তবুও কেউ দমে যায়নি । হাঁটতে হাঁটতে কেউ ক্লান্ত হয়ে গেলে তার কাঁধের ব্যাগ অন্যজন নিয়েছি, যার জন্য যেখানে থামা প্রয়োজন সবসময় তার সাথে কেউ না কেউ থেকেছি । সকলের মিলিত প্রয়াস আর অদম্য সাহসে আমরা একের পর এক ঝর্ণা এবং খাড়া খাড়া পাহাড় পাড়ি দিচ্ছিলাম ।

একদম প্রায় শেষ ঝর্ণাটায় এসে পরিবেশের নির্মল সৌন্দর্য আমাদের বুঁদ করে ফেলে । আমরা নিজেরাও তখনো বুঝে উঠতে পারেনি কতকিছু পার করে এসেছি আমরা এই স্থানে । দানবের মত দাঁড়িয়ে থাকা দাম্ভিকতায় পূর্ণ অথচ শান্ত ঝর্ণাটার দিকে তাকিয়ে থাকাতেই একটা ভালো লাগা কাজ করছিল । আর তার পাশ দিয়েই যখন শেষ খাড়া রাস্তাটা শেষবারের রোমাঞ্চের হাতছানি দেয়, কেউ নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি । ফেরার সময় হয়ে গিয়েছিল আমাদের, কিন্তু তখন সবাই অদেখাকে দেখার নেশায় উন্মত্ত । এই নেশাকে দমিয়ে রাখা দায় । তাই শেষবারের মত আমরা সবচেয়ে খাড়া রাস্তাটা, যার ঢাল প্রায় ৯০ ডিগ্রী, উঠা শুরু করি । এই রাস্তাটার প্রতিটা ধাপেই আমরা সময় নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম । বারবার নিচে তাকিয়েছি, আর একটা কথাই মাথায় আসছিল, ফেরত যাব কিভাবে?! গাছের ডাল, রশি, পাথর- হাতের সামনে যা পেয়েছি তাই আঁকড়ে ধরে রেখে উঠে গেছি । চূড়ায় দাঁড়িয়ে নিজের নিশ্বাসও যেন শোনা যাচ্ছিল । আর সেখান থেকে নিচের দৃশ্যটা ছিল একই সাথে ভয়ংকর এবং তৃপ্তিদায়ক । এবার নামার পালা, আর উঠার চেয়ে নামা আরো দ্বিগুণ ভয়ংকর । কখনো সোজা হয়ে, কখনো পেছনে ফিরে, কখনো বা একদম বসে বসে হামাগুড়ি দিয়ে নামতে থাকলাম আমরা । এত দুর্গম পথ, তাও সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে আমাদের কারোরই হাত-পা ছিলে হালকা-পাতলা রক্ত বের হওয়া ছাড়া আর গুরুতর কিছুই হয় নাই । এভাবে যখন একদম প্রথম ঝর্ণায় নেমে আসলাম, তখন মনে হলো আমার চেয়ে সুখী মানুষ বোধহয় এখন আর কেউ নাই । সমতল মাটিতে পাথরের উপর বসে ছিলাম অনেকক্ষণ, আর উপরের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম দানবদের ছিটেফোঁটা দেখা যায় কি না, যাদের এই মাত্রই জয় করে আসলাম আমরা ।

মীরসরাই এর যেখান থেকে খৈয়াছড়ার ট্রেইল শুরু হয় সেখানকার এক হোটেলেই আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে উঠি । সেখান থেকে মাইক্রোতে উঠে ফের যাত্রা শুরু, এবার গন্তব্য মহামায়া লেক ।

বিশাল মহামায়া লেকে কায়াকিং

ট্রেকিং এর ক্লান্তি তখনো পুরোপুরি মুছে যায়নি, কিন্তু তবুও কায়াকিং এর রোমাঞ্চ ঠিকই ছিল সবার ভেতরে । তার জোরেই বিকাল ৪টার দিকে আমরা কায়াকিং শুরু করি, ২৪ জনের জন্য ১২ টা কায়াক ।

মহামায়া লেক অসম্ভব শান্ত-শিষ্ট একটা লেক । চারিদিকে গাছগাছালিতে ঘেরা আর মাঝে মাঝে ছোট খাটো দ্বীপ লেকটাকে অদ্ভুত নৈসর্গিক সৌন্দর্য দান করেছিল । পানিতে কায়াকের শব্দ ছাড়া আশেপাশে আর কোন শব্দই ছিল না । কিছুক্ষণ পরেই হাত ব্যাথা করছিল, কিন্তু এত বিশাল লেকটা ঘুরে দেখার ইচ্ছার কাছে সবকিছুই হার মানে তখন । তাই নীরব লেকে আমার আর ফাবিহার কায়াকটা আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় সামনে ।

এই শান্ত লেকেও অশান্ত কিছু জলদস্যু ছিল । বিশেষ করে জামিল আর আনিকার কায়াক । যেখানেই যাই সেখানেই তারা এসে হাজির হতো এবং আর কিছু পারুক বা না পারুক আমাদের কায়াকে একটা ধাক্কা তারা দিবেই দিবে । কারো কোন ঝঞ্ঝাটে যাব না নীতিতে বিশ্বাসী আমরা শান্তিপূর্নভাবে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু বাকি কায়াকগুলো জামিল-আনিকাদের দেখাদেখি আমাদের শান্তিপূর্ণ চলাচলে চরম বাঁধার সৃষ্টি করে । তারা নিজেরাও নিজেদের মধ্যে গুতোগুতি করে, কিন্তু নিরীহ কায়াককে আঘাত করতে আমাদের পিছনে সর্বদাই লেগে ছিল ।

শেষ বেলায় সূর্য যখন প্রায় ডুবি ডুবি, আমাদের নির্ধারিত এক ঘন্টাও তখন শেষ । এর মধ্যেই সবাই ১২টা কায়াক কিভাবে কিভাবে যেন এক জায়গায় হয়ে গেলাম । একটা আরেকটাকে ধরে রেখে সিরিয়াল অনুসারে সাজিয়ে আমরা আমাদের কায়াকিং সেলফিটাও তুলে ফেললাম ।

সূর্যাস্তে লেকের সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি পায়, লেকের পানিতে তখন লালচে সূর্যের প্রতিফলন হচ্ছিল । পাখিরা যেমন তাদের নীড়ে ফিরে যাচ্ছিল, আমরাও নীরবে তীরে ফিরে যাচ্ছিলাম ।

তীরে এসে যেমন তরী ডুবে, তেমনি মোবাইলও ডুবে । পুরো কায়াকিং এর সময় এত গুলো সেলফি তুললো নাফিস কিন্তু তাও নিজের মোবাইল সামলে রেখেছিল, যেই না তীরে এসে কায়াক থেকে নামবে অমনি মোবাইল লেকে বিসর্জন দিয়ে দিল । যদিও শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত মোবাইল এর গুরুতর কিছুই হয়নি ।

রিয়ার বাসায় পেটপূজো

মহামায়া লেক থেকে বের হতে হতে তখন সূর্য পুরোপুরি ডুবে গেছে প্রায় । মাইক্রোতে করে এবার হোটেলে ফেরার পালা । পথে চট্টগ্রাম এর জ্যাম সম্পর্কে ধারণা হয়ে গেল । এক ঘন্টার রাস্তা দুই ঘন্টার উপর লাগলো । রাত ৮ টার দিকে আমরা হোটেলে পৌছালাম, ক্লান্তিতে কেউ কেউ ছোট খাটো ঘুমও দিয়ে দিয়েছিল । ফ্রেশ হয়ে সবাই বের হয়ে গেলাম রিয়ার বাসার উদ্দেশ্যে ।

রিয়ার বাসায় আমরা রিয়া সহ ২৩ জন । অত্যন্ত সুন্দর আতিথেয়তা করলো আন্টি-আংকেল । খাওয়ার ব্যাপারে কোন রকম কার্পণ্য না করে সবাই ভরপেট খেয়ে ফেললো । খাওয়া-দাওয়া শেষে অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় আমরা নোয়াখালীর পরিচয় দিলাম, খেয়েই দৌড় ।

পূর্ব পরিকল্পনায় চন্দ্রনাথ পাহাড় ছিল, কিন্তু রাতে হোটেলে ফেরার পথেই চন্দ্রনাথ এর প্ল্যান বাতিল করা হয় । ১৪ তারিখ সন্ধ্যায়ই আমাদের কক্স বাজারের বাস, তাই সেদিন সাধারণ ঘুরাঘুরি ছাড়া আর কিছুই ঠিক করা হয়নি । আর সারাদিনের ক্লান্তিতে সবাই হোটেলেই পৌছেই যে যার রুমে ৷

গ্রামবাসী সবাই জেগে উঠো ২!

১৩ তারিখ দিনটা অসাধারণ ছিল ৷ উঁচু উঁচু পাহাড়ে ঝর্ণা দর্শনের পর নীরব লেকে ভ্রমণ, শেষটা রিয়ার আতিথেয়তার মাধ্যমে ৷ মেয়েরা সবাই শুয়ে পড়লেও ছেলেরা আবার সবাই এক রুমে জড়ো হয়ে মাফিয়া খেলা শুরু করলো৷ ভালো খেলা হচ্ছিল দেখে দুই বার খেলা হলো, শেষবার উত্তেজনা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল । রাতুল যখন বারবার নাফিসের দিকে আঙুল তুলছে মাফিয়া বলে তখনি নাফিস বলে উঠে, “রাতুলের সাথে আমার পার্শোনাল সমস্যা আছে দেখে সে আমারে মাফিয়া বলতেছে!” আবার সবাইকে চুপ করে মামুন এক দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে নাফিসের বিরুদ্ধে বলা শুরু করলো, “আমার রোল ২৮ । নাফিসের রোল ২৭ । আমি নাফিসের মতিগতি খুব ভালোভাবে বুঝতে পারি(!!)” । এতসব উত্তেজনার কারনে এরপর আর কখনো মাফিয়া খেলা হবে না এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ।

রাতভর খেলে ঘুমোতে ঘুমোতে আবারও ৩ টার উপর বাজে৷ যেহেতু চন্দ্রনাথ পাহাড় বাতিল করা হয়, সবার ধারণা ছিল হয়তো একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠা যাবে৷ সাড়ে ৫ টার দিকে আমি ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে রুমে আসতে আসতে ৬ টার একটু বেশি বাজে৷ আগেরদিন ঘুম থেকে তোলা যতটা সহজ ছিল এবার ঠিক ততটাই কঠিন ৷ অন্যান্য রুমের মানুষজন তো আবার দরজা লক করে ঘুমিয়েছে ৷ সেই দরজা ধাক্কা দিয়ে দিয়ে খুলতেই ৫ মিনিট এর উপর লেগে যায়৷ প্রতি রুমে দুইবার, কোন কোন রুমে তিনবারও যেতে হয়েছে, ফ্যান ছেড়ে কম্বল সরিয়ে ফেলার পরেও যখন ঘুম ভাঙছিল না, বালিশ-কোলবালিশ যা ছিল তা দিয়েই বাড়ি মেরে উঠাতে হয়েছে৷ এর মধ্যে মামুনের শরীর থেকে কম্বল সরালে সেখানে একটা ছোটখাটো হাফ প্যান্ট ছাড়া গালিভারের মত শরীরটায় আর কিছুই ছিল না৷ এই দৃশ্য ভয়াবহ ছিল ৷ অর্ধেক কম্বল তাই আবার দিয়ে দিতে হয়েছে ৷

ধাক্কাধাক্কি করে সবাইকে উঠাতে উঠাতে সাড়ে ৭ টার উপর বেজে যায়৷ এদিন মেয়েরাও উঠে দেরি করে, ৭ টা বাজার একটু আগেও যখন তাদের রুমে কোন লাইট জ্বলে না তখন জানালায় নক করলাম, আর ইমির ভাষ্যমতে সেটা হয়ে গেল ৬ টা থেকেই কে বলে জানালা ভেঙে ফেলতেছে(!)

ভাটিয়ারী এবং গুলিয়াখালী

বের হতে হতে ৮ টা বাজে, নিচে নেমে সবাই প্রথমে নাস্তা করলো৷ তারপর ভাটিয়ারী লেকের উদ্দেশ্যে মাইক্রোতে করে যাত্রা শুরু ৷

ভাটিয়ারী লেকে যাওয়ার রাস্তাটা খুব সুন্দর ছিল ৷ মিলিটারি একাডেমীর এরিয়াতে হওয়ায় চারপাশ বেশ সাজানো গোছানো ছিমছাম ছিল, দূর দিগন্তে বড় বড় পাহাড়ও দেখা গিয়েছে এই যাত্রাপথে ৷ ভাটিয়ারী লেকটাও মহামায়া লেকের ন্যায় বেশ বড় ছিল । তবে আমরা লেকে না থেমে লেক পার হয়ে ইকো পার্কে গিয়ে থামলাম ৷ পার্কটা অনেকটা ধানমন্ডি লেকের উন্নত ভার্সন ৷ ৫০ টাকা টিকেট কেটে সবাই ঢুকলাম ৷ পার্কের আনাচে কানাচে চট্টগ্রাম শহরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য- দিকনির্দেশনা । তবে এবার সবগুলোই কপোত-কপোতী বিষয়ক ৷ দুইটা ট্যাংক এর প্রতিমূর্তি ছিল ( একটার নাম অবশ্য এপিসি, এটাকে ট্যাংক বললে আমাদের ক্যাডেটগুলো আবার মাইন্ড করে) সেই ট্যাংক গুলোকে ঘিরে সুদীর্ঘ সময়ের জন্য একটা ফটোসেশন চললো ৷ সবাই যখন মোটামুটি গরমে অতিষ্ঠ আর এখানে আর কিছুই নেই ঘুরার মত বা দেখার মত, সবাই তখন বের হয়ে আসলাম গুলিয়াখালী যাওয়ার উদ্দেশ্যে ৷

গুলিয়াখালী সী বীচ, নামের মধ্যে সী থাকলেও গাড়ি থেকে নেমে দূর দিগন্তেও কোন পানিরাশির চেহারা দেখা তো দূরের কথা, শব্দও শোনা যাচ্ছিল না৷ সেই সী দেখার উদ্দেশ্যে আমরা আরো কিছুক্ষণ হাটলাম, হেটে সবুজ কার্পেটের ন্যায় মাটি পার হয়ে দেখলাম যেদিকে চোখ যায় কেবল কাদা আর কাদা৷ কাদা পার হয়ে সাগরের ঢেউ দেখা যাচ্ছিল ৷ তখনো জোয়ার শুরু হয়নি, তাই পানি অনেক দূরে৷ যে যার মত প্যান্ট গুটিয়ে এই কাদার মধ্যেই আমরা হাটা ধরলাম৷ যতই সামনে এগুতে থাকি, কাদার গভীরতা বাড়তে থাকে ৷ এর মধ্যেই প্রতিটা পা ফেলার সাথে সাথে আশেপাশের ছোট ছোট কাকড়াগুলো গর্তের মধ্যে নিজেদের লুকিয়ে ফেলছিল, যেন অত্যাচারী রাজার আগমনে গ্রামবাসী সবাই যে যার ঘরে লুকিয়ে পড়ছে৷ সেই গর্তে পানি ঢুকলেই আবার তারা ভেসে উঠতো ৷

ছেলেরা মোটামুটি প্যান্ট গুটিয়ে কিংবা হাফ প্যান্ট পরে হাটু সমান কাদা পার হয়ে যায়, কিন্তু মেয়েরা কাদায় মাখামাখি করে জামায় নতুন ডিজাইন তৈরি করে ফেলে ৷ আছাড় খাওয়া থেকে অক্ষত অবস্থায় সবাই সমুদ্রে গিয়ে পৌছালাম ৷ সেখানেও পানির নিচে কাদা৷ আর গিয়েই দেখি জোয়ার আসতে শুরু করেছে, হাটু সমান পানি আস্তে আস্তে কোমর সমান পানি হয়ে গেল ৷

জোয়ারের কারনে খুব বেশি সময় থাকা যায়নি ৷ আবার কাদার মধ্যে ট্রেকিং করে আমরা ফিরে আসলাম ৷ সবুজ কার্পেটের মাঠের মাঝে মাঝে গর্তে পানি জমে ছিল, সেই পানিতে হাত পা পরিষ্কার করে আমরা এবার আসল সমুদ্রের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলাম ৷

মেজ্জান খাইলে আইয়ুন

এই নাম উচ্চারণই করতে পারলাম না আমি শুরুতে ৷ আইয়ুন সবসময় আইয়ুইন হয়ে যায় ৷ দুইদিন চট্টগ্রামে ছিলাম, বিখ্যাত মেজবান না খেলে তো হয় না ৷ গুলিয়াখালী থেকে সবাই বের হয়ে প্রথমে হোটেলে গেলাম ব্যাগ নিতে, এরপর সেখান থেকে কক্স বাজার এর বাসের টিকেট কেটে এই মেজবান বাড়িতে আসলাম বিকালে দুপুরের খাবার খেতে ৷

খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমরা সবাই ৬ টার দিকে কক্স বাজার এর উদ্দেশ্যে বাসে উঠে পড়লাম ৷ প্রায় ৫ ঘন্টার এক দীর্ঘ যাত্রাপথ৷ তার উপর দুইদিন কেউই ঠিকমতো ঘুমায়নি ৷ সবাই তাই যে যার মত বাসে উঠেই ঘুমিয়ে পড়লো, রাত সাড়ে এগারোটায় আমরা কক্স বাজার ৷

সাগরপাড়ে সারারাত

১৪ তারিখ এমনিতেই হোটেল সংকট, তার উপর উচ্চদাম৷ তাই তিন রুমের একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া করা ছিল ৷ সেখানে সবাই ফ্রেশ হয়ে রাত ১২ টার পরে আমরা বের হয়ে আসলাম রাতের খাবার খেতে ৷ ডিনার পর্ব শেষ করেই সুগন্ধা বীচের দিকে সবাই চলে গেলাম ৷

দূর থেকে যখন প্রথম সাগরের ঢেউ এর শব্দ কানে আসলো তখনি মনে এক শান্তির ছোয়া বয়ে গেল ৷ দুইদিনের সকল ক্লান্তি যেন এই শব্দে সাগরের সাথে মিশে যাচ্ছিল ৷ রাতের সমুদ্রের এক অদ্ভুত সৌন্দর্য আছে৷ দূর দিগন্ত খুজে পাওয়া যায় না, কোথায় আকাশ আর সাগর মিলিত হয়েছে ৷ আকাশটাও যেমন ধু ধু অন্ধকার, সমুদ্রও ঠিক তাই ৷ যেন অসীম কোন এক গহবর এর মধ্যে আটকে গেছি আমি, আমার চারপাশে কোনকিছুরই কোন অন্ত নেই ৷ দূর থেকে আসা ঢেউ গুলো তাই কাছে না আসা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায় না ৷ যখন কাছে এসে সর্বশক্তি দিয়ে আমাদের উপর আছড়ে পড়ে, তখন যে শান্তি এবং তৃপ্তির ছোয়া বয়ে যায়, মন চায় যেন নিজেকে তাতে বিলিয়ে দেই ৷

রাতটা এতটাই সুন্দর ছিল যে এই রাত যেন শেষ না হয় তার প্রার্থনায় ছিল সবাই ৷ রাত যত বাড়তে বাড়তে থাকে ঠান্ডাও তত বাড়তে থাকে, পা এতটাই ঠান্ডা হয়ে যায় যে একসময় সমুদ্রের পানিকে গরম মনে হয় । এরমধ্যেই সবাই জুবুথুবু হয়ে একসাথে ছিলাম৷ কখনো বেঞ্চে বসে গিটারের তালে গলা ছেড়ে গান চললো, কখনো আবার সাগরের তীরে যেয়ে খালি গলায় সমুদ্রের গর্জনকে পেছনে রেখে গান চললো৷ আবার কখনো কাধে কাধ রেখে গোল হয়ে নিজেদের গানেই সবাই নাচতে লাগলো, যার ফলস্বরূপ অঙ্গন এর মোবাইল বালুতে পড়ে যায় এবং পায়ের নিচে পড়ে হালকা ফেটেও যায় ৷

কক্সবাজার থেকে সূর্যোদয় দেখা যায় না, কিন্তু ভোরের আলো তো ঠিকই দেখা যায় ৷ সেই আলো দেখে সবাই রুমে ফিরলো সকালে ৷ ৩ রুমের ফ্ল্যাট, এর মধ্যে এক রুম মেয়েদের৷ বাকি দুই রুমের একটা বেডরুম, অন্যটা ড্রয়িং-ডাইনিং ৷ যে যেভাবে পারে সেখানেই শুয়ে পড়ে ৷ কেউ দুইজনের বসার সোফায় গুটিশুটি মেরে বাংলার ‘দ’ আকার করে ঘুমায়, কেউবা তিনটা চেয়ারকে এক করে তাতেই বিছানা বানায়, কেউ আবার টেবিলের উপর সোয়েটার রেখে সেটাকে বালিশ বানিয়ে সেখানেই মাথা রেখে ঘুমায় ৷

এবার সবার আগে উঠে রাজিন৷ উঠে সবার ঘুমের পজিশন দেখে কিছু ফটোসেশান করে ৷ প্রতি ১৫-২০ মিনিট অন্তর অন্তর ঘুম থেকে উঠে তার সাথে এরপর কি করব এটা নিয়ে কথা বলে আবার ঘুম দিতাম আমি ৷ প্রতিবার ডেকে তোলে প্রথম প্রশ্ন-
-ঐ জীয়ন, এরপর কি করবি? সবাইকে ডাকবি কখন? -সবাই যেভাবে মরার মত ঘুমাচ্ছে ১০ টার আগে উঠবে না কেউ৷ আরেকটু পরে ডাকি (বলেই ঘুম)
এভাবে সজাগ-ঘুম খেলা চললো কিছুক্ষণ, সাড়ে ১০ টার দিকে সবাইকে আবার তাণ্ডব চালিয়ে উঠানো হলো ৷ নাফিসকে উঠাতে গিয়ে আবার বিছানার পজিশন পরিবর্তন হয়ে যায় ৷ উঠে না দেখে পা ধরে টান দিয়েছিলাম, কিন্তু বিছানার সাথে এতটাই আটকে ছিল যে পুরা বিছানা সহ সে সরে আসে, বিছানার অপর প্রান্তে রাতুল ভীতদৃষ্টিতে একবার নাফিস, একবার আমি আরেকবার বিছানার দিকে তাকাতে থাকে ৷

সব মোটামুটি ঠিকই ছিল, তবুও ছোটখাটো এই বাসাতে যে ২৩ জন ছিল এটার প্রমাণ রেখে গেল তামিম শেষে ৷ বারান্দায় যাওয়ার রাস্তায় কাচের টি-টেবিলটা ক্লথ দিয়ে ঢাকা ছিল, সেটার উপর পা দিয়ে পার হতে গিয়ে কাচ ভেঙে পুরো ধ্বংসাত্মক এক অবস্থা তৈরি হয়৷ তবে বড় কোন দূর্ঘটনা ঘটেনি, এটাই ভালো খবর ৷

প্যারাস্যুটে আকাশে ভ্রমণ

কক্সবাজার এর অন্যতম আকর্ষণ ছিল প্যারাসেলিং । দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে তাই আর দেরি না করে সবাই সিএনজি তে করে ইনানী বীচ এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম৷ মাঝপথেই হিমছড়ির কাছে দরিয়ানগর বীচে প্যারাসেলিং এর ব্যবস্থা ছিল ৷

প্যারাসেলিং এর অভিজ্ঞতা বলে বা লিখে বোঝানো দায় ৷ যখন টান দিয়ে উপরে তুলে নিয়ে যায় শরীরের শিরায় শিরায় শিহরণ দিয়ে উঠে ৷ সাগরের উপর দিয়ে যখন নিয়ে যায় তখন দুই হাত মেলে ধরলে নিজেকে পাখির মত মনে হয়, সী গাল পাখি, যাকে কিছুক্ষণ পর পানিতে নামিয়ে পানি স্পর্শ করিয়ে আবার উপরে তোলা হয় ৷ উপর থেকে সূর্যের আলোর তীব্রতাটা খুব নরম মনে হয় ৷ মিষ্টি এই আলোর প্রতিফলন পড়ে সমুদ্রের উপর, যেটা উপর থেকে দেখতে আরো নির্মল সুন্দর দেখায় ৷ আকাশ পুরো নীল ছিল না, সমুদ্রও পুরোটা নীল ছিল না, আবছা একটা নীলে চারপাশ ছেয়ে গিয়েছিল ৷ গান গাইতে ইচ্ছা করছিল, সুখের কোন গান, কিন্তু বাতাসের আওয়াজও যে এত মধুর হয় তা বুঝিনি তখন, সেই মধুর আওয়াজ এর বিপরীতে তাই কোন সুরও তুলিনি ৷ সেখানে আমি প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্যের নীরব দর্শকশ্রোতা ।

দরিয়ানগর বীচে আমরা প্রায় ৩ ঘন্টার মত ছিলাম, আর এই ৩ ঘন্টার প্রতিটা মুহূর্ত ছিল সুন্দর ৷ যখন কেউ সাগরের উপর ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে, তখনি কেউ সাগর পাড়ে বসে শৈশবকালের ন্যায় বালু দিয়ে স্বপ্ন বানাচ্ছে৷ আবার কেউ সেই বালুতেই প্রিয়জনকে পাশে রেখেই প্রিয়জনের নাম লিখলো, কেউবা একা একা সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে নিজেকে মিশিয়ে ফেলতে সমুদ্র দিয়ে হেটে চললো ৷ আবার কেউ যখন অন্যের স্বপ্নের স্তম্ভ ভেঙে ফেলে তখন তাকে দিয়েই বালুতে মাখামাখি করে আরেক প্রতিমূর্তি বানানোর প্রয়াস চলে৷ তখনি হয়তো অন্য কেউ কাউকে কাধের উপর উঠিয়ে সাগরের পানিতে দৌড়ে যায় ৷ প্রতিটা মুহূর্ত ছিল সুন্দর, কারন সেখানের প্রতিটা মানুষ ছিল সুন্দর ৷ বিকাল সাড়ে ৪ টার পরে দরিয়ানগর থেকে আমরা আবার সিএনজি তে উঠে ইনানী বীচে সূর্যাস্ত দেখার উদ্দেশ্যে ছুটলাম ৷ দিগন্ত কুয়াশাচ্ছন্ন থাকায় সূর্য দিগন্তে যাওয়ার আগেই ডুবে যায়৷ এই সূর্যাস্তটা যেন আমাদের এই স্বপ্নীল সময়ের শেষটাকে বুঝায়৷ এবারের জন্য হয়তো শেষ, কিন্তু পুরোপুরি শেষ নয় ৷ যতদিন এই মানুষগুলো একসাথে আছে, এরকম মুহূর্ত কখনো শেষ হবার নয়৷ তার জন্য পাহার-পর্বত-সাগরের প্রয়োজন নেই, যেকোন স্থান, যেকোন সময়ই যথেষ্ট ৷

শেষ হইয়াও হইলো না শেষ

এবার বাড়ি ফেরার পালা৷ ইনানী থেকে রুমে ফিরে সবাই সবার ব্যাগ রেডি করে সাড়ে ৮ টার ফিরতি বাসে উঠলাম কলাতলী মোড় থেকে ৷ যখনই মনে করা হচ্ছিল এবারের মত সব শেষ তখনি আবাবিল তার জেবিএলটা চালু করলো ৷ ৩৬ সিটের বাসে আমরা ২৩ জন বাদে খুব বেশি কেউ ছিল না ৷ বাসের ভেতরেই সবাই গান গাইতে থাকলো, নাচতে থাকলো৷ বিদায় হয়তো দুঃখের, কিন্তু এই বিদায়তো পুরোপুরি বিদায় নয় ৷ এটা তো কেবলই শুরু, এক নতুন পরিবারের যাত্রার শুরু ৷ যেখানে সবার প্রয়োজনে সবাই সদা জাগ্রত থাকে, যেখানে কেউ সমস্যাগ্রস্ত হলে সবাই মিলে সাহায্য করে, যেখানে নিজের স্বার্থের আগে সবাই অপরকে প্রাধান্য দেয় ৷ এই তিনদিনে আমরা পাহাড়-ঝর্ণা-লেক-সমুদ্র সবই দেখে এসেছি ৷ কিন্তু এই মানুষগুলোকে যেকোন জায়গায় রেখে আসা হোক না কেন, তারা একটা সুন্দর গল্প সবসময়ই উপহার দিবে, কথা রইলো ৷



Share on :